হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের নিয়ে র্যালি ও সমাবেশ
২ মার্চ,২০১২ বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) এর উদ্যেগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হাজার হাজার মানুষের একাংশকে নিয়ে “ভেঙ্গে যাক সকল বাধা, তৈরি হোক চলাচলের সমতা” স্লোগানকে সামনে রেখে বেলা ৩:৩০টায় রাজুভাস্কর্যের সামনে হতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত র্যালী শেষে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায় ছিলেন সেন্টার ফর দ্যা রিহাবিলিটেশন অব দ্যা প্যারালাইজড (সিআরপি)।
সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা এবং সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার অভাবে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদেয়ালের আঁধারে যে মানুষগুলো হুইলচেয়ারে বন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন সেই মানুষগুলোর অস্তিত্ব সবার সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই র্যালি ও সমাবেশ। ব্যানার, ফেস্টুন এবং প্ল্যাকার্ডসহ বর্ণাঢ্য র্যালিটি ছিল “আপনারে আমি গড়তে চাই, একীভূত শিক্ষা চাই” “বাস হোক র্যাম্পযুক্ত, চলাচল হোক বাধামুক্ত” “ঘরের কোনে নয় আর, চাই বাঁচার অধিকার” “নিজের আয়ে চাই বাচতে, সুবিধাচাই চাকরি ক্ষেত্রে” ইত্যাদি নানা স্লোগান মুখরিত, যা পথচারিদের নজর কাড়ে। বি-স্ক্যানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বেশকিছু সংগঠনও নিজেদের ব্যানার নিয়ে এই র্যালীতে অংশ নেয়। সংগঠনগুলো হলো – ব্লগারস ফোরাম, রোটারি ক্লাব অব ঢাকা সেন্ট্রাল, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সরব ডট কম, ওয়াটার এইড এবং মুক্ত আসর। এছাড়াও বি-স্ক্যান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বি-স্ক্যানের নিবেদিত প্রাণ সদস্যগণের তত্বাবধানে অর্ধ শতাধিক হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠন ও এনজিও প্রতিনিধিগণ এই র্যালিতে অংশগ্রহন করেন। সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ নানান শ্রেনী পেশার মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্বরে সেদিন এক প্রাণের মেলা বসেছিলো যেনো।
র্যালি শেষে সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের, এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে জনপ্রিয় লেখক এবং অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং পরিচালক, লেবরেটরী সার্ভিসেস – বারডেম এবং বি-স্ক্যান -প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক জনাব ডা. শুভাগত চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর দ্যা রিহ্যাবিলেটেশেন অব দ্যা প্যারালাইজড (সি আর পি) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সমন্বয়ক মিস, ভ্যালেরি এ টেইলার।
সমাবেশ শুরু হয় বি-স্ক্যান সভাপতি সাবরিনা সুলতানার আবেগময় বত্তৃতা দিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের পরাধীনতার কথা মনে করিয়ে দিতে তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেনো আমাদের দিনের পর দিন বন্দী এই জীবন কাটাতে হচ্ছে? কিভাবে আমরা এই হুইলচেয়ারগুলো নিয়ে ঘরের বাইরে চলাচল করবো কেন তা কেউ ভাবলো না? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত এদেশেও কেন এতবছরেও আমাদের জন্যে হুইলচেয়ার সহায়ক ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলো না এবং আজো হচ্ছে না? সমাজ কি বন্দী করে রেখেছে আমাদের? নাকি ভুলেই গেছে হাজারো -লক্ষ হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষ এক মানবেতর জীবন যাপন করছে একি সমাজের বিচ্ছিন্ন বাসিন্দা হয়ে? সমাজের আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মত মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাচার দাবী জানিয়ে তিনি আরো বলেন- হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কথা আলাদাভাবে ভাবতে হবে। তাদের জন্য সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষার সুযোগ, সর্বোপরি স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা শুধুমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে পরিণত করতে হবে।
মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের এমপি প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঘোষণা দেন- আগামীতে যত সরকারি গাড়ি (বিআরটিসি গাড়ি) আমদানি করা হবে সবগুলোতে র্যাম্প (হুইলচেয়ার ওঠানো-নামানোর ব্যবস্থা) সুবিধা থাকবে। এছাড়া আগামী এপ্রিলের মধ্যে ভারত থেকে ২৯০টি বাস আমদানী করা হচ্ছে যাতে র্যাম্পের ব্যবস্থা রাখা হবে। বাংলাদেশের বর্তমান রাস্তা ঘাট নিজেরাই করুণ অবস্থার শিকার। সুতরাং রাস্তাঘাটগুলো যোগাযোগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে এবং পাশাপাশি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কথাও মাথায় রেখে ফুটপাতগুলোকে হুইলচেয়ার চলার উপযোগী এবং সরকারি ভবনগুলোতে হুইল চেয়ার প্রবেশগম্য টয়লেট করা হবে। তিনি তার বক্তব্যে আরো বলেন- হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী বান্ধব সরকার, তাই আমাদের চেষ্টা সবসময় প্রতিবন্ধী মানুষের দাবী দাওয়ার পক্ষে। আজকের র্যালি ও সমাবেশ থেকে যেসব দাবী দাওয়া তুলে ধরা হয়েছে আমি আমার মন্ত্রাণালয়ের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। সেই সাথে সকল ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শব্দটি পরিহার করে তাদের সক্ষমতা ও সম্মান প্রকাশ করে এমন নামকরনের জন্যেও তিনি আহ্ববান জানান।
বিশেষ অতিথি পরিচালক, লেবরেটরী সার্ভিসেস – বারডেম এবং বি-স্ক্যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক জনাব ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন- সাধারণত আমাদের কেউ যখন জিজ্ঞেস করেন “কেমন আছো?”, আমরা বলি, “আমি ভালো আছি”। স্বার্থপরের মতোন নিজের ভালো থাকাটাকে বড় করে দেখি, ভুলে যাই আমাদের চারপাশে আরো কত মানুষ নানান সমস্যায় আক্রান্ত। ভুলে যাই ভিন্নভাবে সক্ষম এই মানুষগুলোর বঞ্চনার কথা। কেবল একার ভালো থাকা মানবিক গুণাবলীর ভেতরে পড়ে না। যদি কখনো বলতে পারি যে আমরা সবাই ভালো আছি, শুধুমাত্র তখনই সত্যিকার ভালো থাকা প্রকাশ পাবে।এছাড়াও তিনি আরো বলেন- ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য আমাদের দেশে বাস ট্রেন লঞ্চ ইত্যাদিতে কোন সহায়ক ব্যবস্থা নেই অথচ তা আবশ্যকীয়। তাই আমাদের সকলকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ হিসেবে এসবই আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বিশেষ অতিথি জনপ্রিয় লেখক এবং অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন – আজকের র্যালি ও সমাবেশে এসে আমার মনে হচ্ছে যাদেরকে আমরা প্রতিবন্ধী মনে করি তারা যে কতখানি মনেবলের অধিকারী তা তারা প্রমাণ করেছে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাওয়ার অধিকার রাখে। তার জন্য আমাদের সকলকের এগিয়ে আসতে হবে।
সমাবেশের সভাপতি মিস ভেলেরি এ.টেইলার তার বক্তব্যে বলেন – ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি ভংগীর পরিবর্তন প্রয়োজন। তারাও যে স্কুলে যেতে পারে, আনন্দ করতে পারে, বিয়ে করতে পারে শুধুমাত্র আমাদের সকলের সহযোগিতা পেলে তা সাবরিনা ও সালমা প্রমাণ করে দিয়েছেন। সকল নাগরিক সুবিধা সম্বলিত জীবন যাপনের অধিকার তাদেরও আছে এই সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন। ভিন্নভাবে সক্ষম বা বিকল্প দক্ষ ব্যক্তিদের সমান মর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে সমাজকে।
রিহ্যাব এর পক্ষ থেকে ইসি মেম্বার ও চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আনিসুজ্জামান ভুইয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০০৮ অনুযায়ী প্রতিটি বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর প্রবেশগম্যতা ও টয়লেট থাকা আবশ্যকীয় করা হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসায়ী মহল তা মানছেন না। সকলে যেন এই আইন মেনে চলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সাথে তিনি আরো বলেন, কোন ভবনে প্রবেশগম্যতা না পেলে যে কেউ এখন থেকে তাদের অভিযোগ রিহ্যাবে চিঠি লিখে জানালে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
এতে আরো বক্তব্য রাখেন, প্রয়াত বিশিষ্ট ছাত্র নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু সাহেবের সহধর্মিনী খুজিসতা নূরে নাহারিন মুন্নি – তিনি তার প্রয়াত স্বামীর অসুস্থাবস্থায় হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে গিয়ে যে সকল সমস্যার সম্মুখিন হোন তা তুলে ধরেন। সেই সাথে বলেন, সামাজিক সচেতনার জন্য আমাদের শিশুদের মাঝে ছোটবেলা থেকেই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষের বিষয়ে ধারনা দিতে সহায়ক পাঠ্য পুস্তকে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা তুলে ধরতে হবে। আজকের শিশুরা আগামীদিনের সমাজ গঠনে গড়ে তুলবে সমঅবস্থান।বক্তব্য শেষে তার স্বামীর ব্যবহৃত হুইলচেয়ারটি ভিন্নভাবে সক্ষম নারী ময়না বেগমকে দান করে দেন।
তবে কি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কষ্ট বুঝবার জন্য অন্যদেরও হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হোক, এই অভিশাপ দেব ?
–সহায়ক ব্যবস্থার অভাবে নিয়মিত কলেজে ক্লাস করতে না পেরে চারদেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থাকতে থাকতে ক্লান্ত সুমাইয়া বিনতে শফির এমন অভিমানী কন্ঠ শুনে সেদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে উপস্থিত সকলের হৃদয় থমকে গিয়েছিলো কিছুক্ষনের জন্যে। কতটা ক্ষোভ মনে চেপে রাখলে মানুষ এভাবে বলতে পারে ভেবে অনেকের চোখ ভিজে উঠেছিলো যেনো। সেদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আগত আরো কয়েকজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর কাছে নিজেদের এ সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা অমান্য করার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য কোন যানবাহন না থাকার কথা উল্লেখ করেন। এই পর্যায়ে তারা জোরদার ভাবে র্যাম্পযুক্ত বাস আমদানীর দাবী জানান। তারা হলেন মোঃ জাহিদুল ইসলাম, এমবিএ তে অধ্যায়নরত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মেজর জহিরুল ইসলাম, উন্নয়ন কর্মী আব্দুর রহিম, প্রাক্তন মেরিন অফিসার মোঃ শহিদুল আলম, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের ছাত্র অনয়ের বাবা ব্যবসায়ী জনাব কে এম মোবারক উল্লাহ, নারায়নগঞ্জ মহিলা কলেজে এইচ.এস.সি. প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত সুমাইয়া বিনতে শফি।
সম্পৃতি ফোরাম, ব্লগারস ফোরাম, ইস্টার্ন মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটাল, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল, ব্যাবিলন এবং টিম – এর পৃষ্ঠপোষকতায় উক্ত র্যালী ও সমাবেশে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিলেন সময় টিভি এবং রেডিও টুডে।
পুরো আয়োজনটি সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা ইসলাম এবং ইশারা ভাষায় অনুবাদক ছিলেন আরিফুল ইসলাম।